বর্তমানে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (MLM) নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত। কেউ এটিকে মনে করেন স্মার্ট ইনকামের সুযোগ, আবার কেউ বলেন প্রতারণার ফাঁদ। এই লেখায় আমরা জানব, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং আসলে কী, এর মূল ধারণা, ধরন ও কার্যপ্রণালী।
পাশাপাশি থাকছে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, ইতিহাস, ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি, সফলতার কৌশল, বিতর্ক এবং বাংলাদেশে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ। এক নজরে নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের সবকিছু জানতে পুরো লেখাটি পড়ে ফেলুন।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কি?
মার্কেটিং (Network Marketing) হলো এমন একটি বিক্রয় কৌশল, যেখানে ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক বা পরিচিতজনের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ভোক্তার নিকট সরাসরি পৌঁছানো হয় । এখানে বিক্রয় প্রতিনিধি নিজের পরিচিতজনদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি এবং নতুন সদস্যদের দলে বা মার্কেটিং নেটওয়ার্কে ভেড়ানোর মাধ্যমে কমিশন অর্জন করেন। এটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (MLM) নামেও পরিচিত।
আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং মূলত এমন এক ব্যবসায়িক মার্কেটিং মডেল, যেখানে একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের বিক্রয়ের উপর নয়, বরং তার দ্বারা গঠিত দলের বিক্রয়ের উপরেও আয় করেন। এটি একটিরবিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলে, যেখানে প্রতিটি নতুন সদস্য নতুন ক্রেতা ও সদস্য তৈরি করতে উৎসাহিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আপনি একটি কোম্পানির পণ্য বিক্রি করে কমিশন অর্জন করছেন। আবার আপনি একজন নতুন সদস্যকে দলে নেন, এবং সে যদি বিক্রি করে বা নতুন সদস্য যুক্ত করে, তাহলে আপনি তার কাজের উপর একটি কমিশন পাবেন। এভাবে এই ধারা চলমান থাকবে যার মাধমে আপনি একটি বিক্রয় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে আয়ের উৎস তৈরি করবেন।
এধরনের নেটওয়ার্ক মার্কেটিং প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে-
- Single-Tier Marketing: এক্ষেত্রে আপনি সরাসরি বিক্রয়ের মাধ্যমে আয় করেন, সদস্য তৈরি করার চাপ নেই।
- Two-Tier Marketing: যেখানে আপনি সরাসরি বিক্রয়ের পাশাপাশি আপনার দ্বারা নিয়োগকৃত সদস্যের বিক্রয় থেকেও আয় করবেন।
- Multi-Level Marketing (MLM): আপনি একাধিক স্তরে সদস্য তৈরি করে তাদের কাজের উপর কমিশন পাবেন। এই ধরণের মার্কেটিং-ই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর মৌলিক ধারণা
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং সফলভাবে গড়ে তুলতে হলে এর কিছু মৌলিক ধারণা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান থাকা জরুরি। নিচে প্রতিটি ধারণা সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলোঃ
১. ডাইরেক্ট সেলিং (Direct Selling)
ডাইরেক্ট সেলিং মানে হলো কোনো ধরনের দোকান বা ট্রেডিশনাল রিটেইলার ছাড়াই, পণ্য বা সেবা সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ধরুন, আপনি একটি হেলথ সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধি। আপনি আপনার বন্ধু বা আত্মীয়দের মাঝে পণ্যটির উপকারিতা তুলে ধরে সরাসরি বিক্রি করলেন।
২. রেফারেল মার্কেটিং (Referral Marketing)
রেফারেল মার্কেটিং হল এমন এক পদ্ধতি, যেখানে আপনি নতুন ক্রেতা বা সদস্যকে পরিচয় করিয়ে দিলে, কোম্পানি আপনাকে পুরস্কার বা কমিশন দেয়। যেমনঃ আপনি যদি আপনার এক বন্ধুকে একটি বিউটি প্রোডাক্ট কিনতে বলেন এবং সে যদি আপনার রেফারেল ব্যবহার করে পণ্যটি কেনে, তাহলে আপনি তার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন বা ইনসেনটিভ পাবেন।
৩. কমিশন-ভিত্তিক আয় (Commission-Based Income)
এক্ষেত্রে একজন প্রতিনিধি যত বেশি পণ্য বিক্রি করেন বা তার টিম যত বেশি বিক্রি করে, সেই অনুযায়ী কোম্পানি তাকে নির্দিষ্ট কমিশন দিয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আপনি যদি প্রতি বিক্রয়ের উপর ১০% কমিশন পান, তাহলে ৫,০০০ টাকার পণ্য বিক্রি করলে আপনি পাবেন ৫০০ টাকা। আবার, আপনার টিম যদি ৫০,০০০ টাকার পণ্য বিক্রি করে, তাহলে নির্ধারিত হারে টিম কমিশন হিসেবেও আপনি আয় করতে পারবেন।
৪. টিম বিল্ডিং (Team Building)
একজন সফল নেটওয়ার্ক মার্কেটার নিজের মতো আরও সদস্য তৈরি করে, যারা নিজেরাও পণ্য বিক্রি করে এবং নতুন মার্কেটিং সদস্য তৈরি করে। ধরুন, আপনি ৩ জন নতুন সদস্য নিয়োগ দিলেন, তারা প্রত্যেকে নিজের মতো করে বিক্রি শুরু করলো। এরপর তারাও যদি নতুন ২-৩ জন সদস্য নিয়োগ দিলো, তাহলে আপনি ধাপে ধাপে একটি বড় ডাউনলাইন টিম তৈরি করতে পারবেন।
৫. লেভেল এবং ডাউনলাইন (Levels & Downline)
আপনি যাদেরকে সরাসরি সদস্য করেছেন, তারা আপনার প্রথম লেভেলের ডাউনলাইন। তারা আবার যাদেরকে সদস্য করবে, তারা দ্বিতীয় লেভেল, এভাবে একাধিক স্তর (লেভেল) তৈরি হবে। ধরুন, আপনি প্রথমে ৪ জন সদস্য নিলেন, তারা হলো আপনার প্রথম লেভেল। এরপর তাদের প্রত্যেকে যদি আবার ৩ জন করে সদস্য নেয়, তাহলে তারা আপনার দ্বিতীয় লেভেলের সদস্য হয়ে যাবে। যত নিচের স্তর তৈরি হবে, তত বড় হবে আপনার নেটওয়ার্ক এবং ইনকামের সুযোগ।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কত প্রকার?
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং একাধিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, এবং বর্তমানে এই পদ্ধতিগুলোর ধরন আরও বিস্তৃত হয়েছে।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর প্রধান প্রকারসমুহ হলো-
- মাল্টিলেভেল মার্কেটিং
- টেলিমার্কেটিং
- সিঙ্গেল-টিয়ার মার্কেটিং
- টু-টিয়ার মার্কেটিং
- আফিলিয়েট মার্কেটিং
- ডিরেক্ট সেলিং
- রেফারেল মার্কেটিং
- ইন্টারনেট, ই-কমার্স বা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের প্রতিটি ধরনেই রয়েছে আলাদা কৌশল, সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা। আপনি যদি এই খাতে কাজ করতে আগ্রহী হন, তাহলে পরবর্তী অংশগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কিভাবে কাজ করে?
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং মূলত এই পাঁচটি ধারণার ভিত্তিতে কাজ করে যার মধ্যে নতুন সদস্য যুক্ত করলে তার বিক্রয়ের উপর কমিশন পাওয়ার মত ব্যপার রয়েছে। নিচে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং আর যে যে ধারণার উপর ভিত্তি করে কাজ করে তা উল্লেখ করা হল:
- সদস্য নিজে পণ্য বিক্রি করে সরাসরি আয়।
- নতুন সদস্য যুক্ত করলে তার বিক্রয়ের উপর কমিশন পাওয়া যায়।
- নিজের অধীনে নতুন সদস্য যোগ করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়।
- একাধিক স্তরের মাধ্যমে আয়ের পরিধি বিস্তৃত হয়। অর্থাৎ যত বড় টিম, তত বেশি আয়।
- বিক্রয় ও রেফারেল সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বোনাস, কমিশন ও বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করা হয়।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের বৃদ্ধি মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করে। প্রথমত, ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক বা যোগাযোগ পরিসর যত বড়, তত দ্রুত একজন সদস্য তার ডাউনলাইন গঠন করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, যে পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, সেটির মান ও প্রয়োজনীয়তা যদি গ্রাহকদের মাঝে থাকে, তাহলে বিক্রি সহজ হয় এবং গ্রাহকের আস্থা তৈরি হয়। এর পাশাপাশি বিক্রয় ও কমিউনিকেশন স্কিল, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডলিং, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে সদস্যরা আরও সফলভাবে কাজ করতে পারে।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর সুবিধা ও অসুবিধা
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং যেমন সদস্যদের স্বাধীনভাবে আয়ের সুযোগ দেয়, তেমনি এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। নিচে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো।
সুবিধা | অসুবিধা |
সদস্যরা নিজেদের সময়ে কাজ করে আয় করতে পারেন। | নতুনদের জন্য শুরুতে সফল হওয়া কঠিন হতে পারে। |
অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় কম পুঁজিতে শুরু করা সম্ভব। | অনেক সময় সঠিক প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনার অভাব দেখা যায়। |
নতুন সদস্য রিক্রুট করার মাধ্যমে আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। | প্রথম দিকে সময় ও শ্রম বেশি দিয়ে সফলতা আসতে দেরি হতে পারে। |
সদস্যরা নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করে এক ধরনের এন্টারপ্রেনার হয়ে ওঠেন। | পিরামিড স্কিম আইনগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। |
অনেক ক্ষেত্রে কম সময়ের মধ্যে বড় আয়ের সুযোগ থাকে। | কিছু এলাকায় বা বাজারে নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের প্রতি বিরোধিতা থাকতে পারে। |
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ইতিহাস
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ধারণাটির উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুয়ায়ী ১৯২০ থেকে ১৯৩০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের “California Vitamin Company” এবং “California Perfume Company” এর ব্যবসায়িক মডেলে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ধারনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে এর উত্থান ঘটে ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে, যখন Amway Company-সহ আরও অনেক কোম্পানি এই মডেলকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করতে শুরু করে। এই সময়েই পণ্য বিক্রির সঙ্গে সদস্যদের নতুন সদস্য রিক্রুটমেন্টকে যুক্ত করা হয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ সালের মধ্যে, এই ব্যবসার মডেলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
আজকের দিনে, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং একটি বৈশ্বিক শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শতাধিক দেশ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে, এবং এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করছে। এই শিল্পটি একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যার বার্ষিক রাজস্ব প্রায় বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং প্রথাটি প্রবেশ করে ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে। প্রথমদিকে, কিছু বিদেশি কোম্পানি, যেমন Amway এবং Herbalife, বাংলাদেশের বাজারে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি দেশের ব্যবসায় খাতে স্থান করে নেয়। বেশ কিছু বছর পর, দেশি কোম্পানিগুলিও এই মডেল গ্রহণ করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন পণ্য নিয়ে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং শুরু করে।
এই ব্যবসায়িক মডেলটি কিছু মানুষের জন্য আর্থিক স্বাধীনতা এনেছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি নতুন আয়ের পথ খুলে দিয়েছে। তবে, বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কখনও কখনও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, কারণ কিছু কোম্পানি পিরামিড স্কিমের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা গ্রাহকদের ক্ষতির অন্যতম কারণ ।
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর ব্যবসায় শতাধিক কোম্পানি নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় এই ব্যবসায় রয়েছে, তবে ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক ও সদস্য এই পদ্ধতিতে যুক্ত রয়েছেন। যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি, তবে অনুমান করা হয়, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক আয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা হতে পারে।
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং একটি বৈধ ব্যবসা হিসেবে গণ্য হলেও, এটি পরিচালনা করার জন্য কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ২০১৩ সালে একটি আইনি কাঠামো প্রবর্তন করার জন্য বাংলাদেশ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসায় পরিচালনা করা যাবে, তবে কোম্পানিগুলোর কাছে সঠিক লাইসেন্স, গ্রাহক সুরক্ষা, এবং ব্যবসার শর্তাবলী স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা আবশ্যক। তবে এর পরবর্তীতে ২০১৫ সালে, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে সকল ধরণের দেশি-বিদেশি এমএলএম ব্যবসায় নিষিদ্ধ করে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের জন্য শরিয়তের যে হারাম হালাল নির্ধারন করে দিয়েছে তা আমাদের অবশ্যই মানতে হবে। হারাম দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র- সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই প্রতিটা কাজ করার পূর্বে তা হালাল নাকি হারাম এই বিষয়টি সর্বপ্রথম স্পষ্ট করে নিতে হবে। বলা হয়েছেঃ
শরীরের যতটুকু মাংস হারাম থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তা জাহান্নামের জন্যই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। [মুসনাদে আহমদ; তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৭২]
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং হালাল বা হারাম হওয়া নির্ভর করে এর কার্যপ্রণালী ও কাঠামোর ওপর। যদি এটি পণ্য বা সেবা বিক্রি সম্পর্কিত প্রকৃত ব্যবসায় হয় এবং সদস্যদের পণ্য বিক্রির ভিত্তিতে আয় দেওয়া হয়, তবে এটি হালাল হতে পারে। কিন্তু, যদি পণ্য বিক্রি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নতুন সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে আয় হয়, তবে এটি পিরামিড স্কিম হিসেবে গণ্য হবে, যা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী হারাম। এ সম্পর্কে বিস্তারিত দলিল প্রমাণসহ পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হবে ইং শা আল্লাহ।
বাংলাদেশে বেশ কিছু দেশীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে, প্রতিষ্ঠানে আইনগত জটিলতার কারণে ব্যবসার আস্থা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের প্রসার হচ্ছে।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কি হালাল নাকি হারাম?
ইসলামে ব্যবসায় বা অর্থ উপার্জনে মৌলিক চারটি বিষয়কে হারাম করা হয়েছে।
১. অন্যকে ধোকা বা মিথ্যা বলে উপার্জন।
২. অন্যের ক্ষতিসাধন করে উপার্জন।
৩. অজানা জিনিস বিক্রি, হারাম জিনিস বিক্রি বা অস্পষ্ট মূল্য ও নীতি নির্ধারণ করে উপার্জন। যেমনঃ জুয়া, গোপন চার্জুক্ত কিস্তি, ইত্যাদি।
৪. সুদ।
একটি কার্যক্রম হালাল হবে যদি তা ইসলামিক শারিয়াহ অনুযায়ী সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং হারাম হবে যদি সেখানে কোনো প্রকার শরিয়াহ বিরোধী অসত্য, প্রতারণা বা বেআইনি কাজ থাকে। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এ যদি পণ্য বিক্রয়কে মূলনীতি হিসেবে গ্রহন করা হয় তবে এটা ব্যবসায়েরই একটি প্রকারভেদ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে ব্যবসার মাধ্যমে (গ্রহণ করলে তা বৈধ )। (নিসাঃ ২৯)
যেকোনো কোম্পানি থেকে পণ্য কিনে অপরজনের কাছে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বৈধ অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। অনুরূপ কোনো ক্রেতা সংগ্রহ করে দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানির কাছ থেকে দালালীর কমিশন নেয়ার অধিকারও প্রত্যেকের রয়েছে। কারণ এ উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ শ্রম জড়িয়ে আছে।
প্রায় অধিকাংশ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ নিম্ন লেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর কর্তৃক বিক্রিত পণ্যের একটি কমিশন সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত পায়। যেটাকে এক কথায় ‘শ্রমের বহুস্তর সুবিধা’ বলা যায়। তাদের এ নীতিটির সাথে ইসলামের শ্রমনীতির রয়েছে সরাসরি সংঘর্ষ।
‘‘কোনো মানুষই অপরের বোঝা উঠাবে না। মানুষ ততটুকুই পাবে যতটুকু সে চেষ্টা করে’’ [সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩৮-৩৯]
এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মানুষ কেবল তার নিজের শ্রমের প্রত্যক্ষ ফল লাভের অধিকারী। একজন শিক্ষক সে তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ফল হিসেবে বেতন দাবি করতে পারে। কিন্তু সে যদি দাবি করে, তার ছাত্ররা যত জনকে শিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও যাদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে তাদের প্রত্যেকের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ উর্ধবতন শিক্ষককে কমিশন হিসেবে দিতে হবে তাহলে বিষয়টি মানবীয় সুস্থ বিবেক থেকেও মেনে নেয়ার মত নয়।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এ বেশী লাভের আশায় প্রাশই পণ্য বিক্রয়কে ফোকাস না করে কর্মীদের সদস্য সংগ্রহের দিকে তাগিদ দেয়া হয় এবং এভাবে স্তরে স্তরে কর্মীসংখ্যা বাড়ে। অতিরিক্ত কমিশনের ফলে পণ্যের দাম বাজার দরের থেকে বহুগুনে বেড়ে যায় ফলে ক্রেতারা প্রতারিত হয়।
মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১০২; মিশকাত, হা/২৮৬০)।
তবে যদি ন্যায় ও ইনসাফের সাথে পণ্য বিক্রির কাজ করা যায় এবং নির্দিষ্ট কাছাকাছি স্তর পর্যন্ত কমিশন নেয়া হয় তবে তা বৈধ। এধরণের ব্যবসায়ে সফলতাও এসেছে, কিন্ত যারাই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে তারা কেউই টিকে থাকতে পারেনি।
তাই দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের জন্য আমাদের এসধনের ব্যবসায়ে জড়িত হবার পূর্বে সকল বিষয় সুস্পষ্ট জেনে নিতে হবে, কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“নিশ্চই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট, আর এ উভয়ের মাঝে রয়েছে বহু অস্পষ্ট বিষয়, অধিকাংশ লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এ সব অস্পষ্ট বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে তার দীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে। আর যে লোক অস্পষ্ট বিষয়ে পতিত হবে, সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে।” [সহীহ মুসলিম – 1599]
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং সফল হওয়ার টিপস
- নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা শুরু করার আগে সবচেয়ে প্রথম কাজ হলো একটি নির্ভরযোগ্য কোম্পানি নির্বাচন করা।
- মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এবং পিরামিড স্কিমের মধ্যে পার্থক্য বোঝা।
- এমন পণ্য বেছে নিন যা বাজারে চাহিদা রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে প্রচলিত।
- আপনার নেতৃত্বের গুণাবলী উন্নত করতে মনোযোগ দিন এবং সদস্যদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন।
- নতুন সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজন করুন
- টাইম মেনেজমেন্ট করে প্রতিদিন কাজ করুন।
- আপনার গ্রাহক ও সদস্যদের সঙ্গে সৎ, সতর্ক এবং স্বচ্ছ ব্যবসয় পরিচালনা করুন।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং নিয়ে বিতর্ক
নেটওয়ার্ক মার্কেটিংকে অনেক সময় পিরামিড স্কিমের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পিরামিড স্কিমে, সদস্যরা লাভ উপার্জন করতে নতুন সদস্যদের রিক্রুট করতে থাকে, কিন্তু সেখানে পণ্য বিক্রি বা সেবা প্রদান করা হয় না। এটি মূলত একটি প্রতারণামূলক ব্যবসায় মডেল। যদিও নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের মধ্যে পণ্য বিক্রি রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ কম্পানি এই পিরামিড স্কিম মডেল গ্রহণ করায় নেটওয়ার্ক মার্কেটিং সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়।
এছাড়া নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসায় অনেক সময় ব্যবসায়ীরা দ্রুত ও অতিরিক্ত লাভের আশ্বাস দেন, যা অনেকেই বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজে পায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। আবার নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এমন পণ্য বাজারজাত করে, যেগুলো গ্রাহকের দৃষ্টিতে মানসম্মত না।
নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বিষয়ক বিতর্কের মধ্যে ইসলামী আইনেও এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিছু স্কলার মনে করেন, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং যদি সৎভাবে পরিচালিত হয় এবং তাতে প্রতারণা না থাকে, তবে তা হালাল হতে পারে। তবে যদি পিরামিড স্কিম বা অবৈধ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকে, তবে তা হারাম হবে। আবার কিছু স্কলার নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর ব্যাপক প্রতারণার উপর ভিত্তি করে এই গোটা মডেলটিকেই হারাম বলেছেন। তাই একে পুরোপুরি ন্যায্য বা হালাল মনে করার আগে বিশদভাবে চিন্তা করা উচিত।
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং জনপ্রিয় হলেও এটি নানা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। একদিকে যেমন হাজারো মানুষ এই খাতে যুক্ত হয়ে আয় করছে, অন্যদিকে প্রতারণা ও পিরামিড স্কিমের অর্থাৎ শুধুমাত্র সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে আয় করায়, এটি আইনি জটিলতার মুখে পড়ছে।
তবে সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এবং আইন ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে ব্যবসা করা গেলে, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই খাত আরও বিস্তৃত হবে।